পুঁজিবাজারে বিদেশি লেনদেন কমেছে ১০,২৫১ কোটি টাকা
দেশের পুঁজিবাজারে কয়েক বছর ধরে বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। বছরজুড়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে পরিমাণ শেয়ার ক্রয় করে থাকেন, বছর শেষে দেখা যায় তাদের বিক্রি ছিল তার চেয়ে বেশি। ২০২২ সালে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমেছে ৩৯ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার বা চার হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি (বর্তমান ১০৮ টাকা ডলার মূল্য ধরে)।
এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বিনিয়োগ কমে দাঁড়িয়েছিল ৭০ কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার ডলারে। বাজারে সুশাসনের অভাব, আস্থাহীনতা, ডলারের দাম বৃদ্ধি, শেয়ার নিয়ে কারসাজি এবং কারসাজিকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলে জানান বাজার সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
তথ্যমতে, গত বছর পুঁজিবাজারে বিদেশিদের মোট লেনদেন হয়েছে ১০৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ১১ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বছরের প্রথম ছয় মাস হয়েছে (জানুয়ারি–জুন) ছয় হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা এবং শেষ ছয় মাসে (জুলাই–ডিসেম্বর) হয়েছে পাঁচ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।
বছরজুড়ে বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় করেছে তিন হাজার ৭৮৬ কোটি ৯১ লাখ টাকার এবং শেয়ার বিক্রি করেছে আট হাজার ১৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকার। সে হিসাবে গত বছর বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি চার হাজার ২৩০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বা প্রায় ১১২ শতাংশ বেশি হয়েছে। বছরের প্রথম ছয় মাসে বিদেশিদের শেয়ার ক্রয় হয়েছে দুই হাজার ২৮১ কোটি টাকার এবং বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৪০৩ কোটি টাকার।
সে হিসাবে ছয় মাসে শেয়ার কেনার তুলনায় বিক্রি দুই হাজার ১২২ কোটি টাকা বা ৯৩ শতাংশ বেশি হয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের প্রতি বিমুখ। ফলে আগের তুলনায় বিদেশিদের লেনদেন ও বিনিয়োগ অনেক কমেছে। এর অন্যতম কারণ আস্থার সংকট, যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। বাজারে কারসাজিকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। কারসাজির বিপরীতে শাস্তি খুবই কম।
আবার অনেক কারসাজির শাস্তিই হয় না। শুধু তদন্ত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। এছাড়া কভিড–১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশেকে নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে বর্তমানে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ায় অনেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন।
কারণ ডলারের বিপরীতে তাদের ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। তাছাড়া ফ্লোর প্রাইসের কারণে অনেকে শেয়ার কিনে ঠিক সময়ে বিক্রি করতে পারছেন না। বিদেশিদের বিনিয়োগের বেশিরভাগ শেয়ারই রয়েছে ফ্লোর প্রাইসের কাছে। সেই সঙ্গে কারসাজির শেয়ার ছাড়া ভালো মৌলভিত্তি শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে বিক্রিতে পাওয়া যায় না ক্রেতা। তবে কেউ কেউ স্বল্প সময়ে মুনাফা তুলে নিলেও এখনও বিদেশি লেনদেন হচ্ছে।
এদিকে ২০২২ সালের পরের ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনেছেন এক হাজার ৫০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকার এবং তিন হাজার ৬১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। সে হিসাবে শেষের ছয় মাসে বিদেশিরা দুই হাজার ১০৮ কোটি টাকার বা ১৪০ শতাংশ বেশি শেয়ার বিক্রি করেছেন।
এর আগের বছরগুলোর মধ্যে ২০২১ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশিদের অংশগ্রহণ ছিল মোট ২০৪ কোটি ২১ লাখ ৮০ হাজার ডলারের বা ২২ হাজার ৫৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে বিদেশিরা শেয়ার কিনেছেন ৬৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের বা সাত হাজার ২৩০ কোটি টাকার এবং শেয়ার বিক্রি করেছেন ১৩৭ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার ডলারের বা ১৪ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার।
সে হিসাবে ২০২১ সালে বিদেশিদের শেয়ার কেনা থেকে বিক্রি সাত হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা বা ১০৫ শতাংশ বেশি করেছে। ২০২১ থেকে ২০২২ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন কমেছে ৯৪ কোটি ৯২ লাখ ডলার বা ১০ হাজার ২৫১ কোটি টাকার বা প্রায় সাড়ে ৪৬ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর দেশ–বিদেশে বিনিয়োগ নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন দেশে রোড–শো করে বিএসইসি। এর মধ্যে ইউরোপ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশ রয়েছে। গত তিন বছরে তারা বেশ কয়েকটি দেশে রোড–শো করেও সে পরিমাণে বিনিয়োগ নিয়ে আসতে পারেনি।
এর বিপরীতে বছরে বছরে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। আর যেটুকু লেনদেন হচ্ছে, সেখানে শেয়ার কেনার থেকে বিক্রি হচ্ছে বেশি। তাহলে এত রোড–শো করেই বা কী লাভ হয়েছে? এসব রোড–শো করে কোনো লাভ হবে না, যত দিন না বাজারে সুশাসন নিশ্চিত হবে, কারসাজিকারীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে, কারসাজির জন্য কঠিন ও গুরুতর শাস্তি দেয়া হবে। নিশ্চিত করতে হবে যাতে একজন কারসাজিকারী যেন আর কারসাজি করতে না পারে। সেই সঙ্গে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক রাখতে হবে।
কারণ ফ্লোর প্রাইসের কারণে অনেকে শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। শেয়ারদর স্বাভাবিক না হলে নতুন করে বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। এরকম নানা সমস্যা দূর করতে হবে। তাহলে এই বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটেও বিদেশিদের বিনিয়োগ অনেক বৃদ্ধি না পেলেও অংশ নেয়ার হার বাড়বে। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বিদেশিরা শেয়ার কিনে বিক্রি করতে না পরলে তারা কেন আসবেন। কারসাজির শেয়ারে তাদের আগ্রহ নেই। কিন্তু মৌলভিত্তি শেয়ারে যদি বিনিয়োগ করে ব্যবসা করতে না পারেন, তাহলে তো তারা অন্য জায়গায় চলে যাবেন।
ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারের দাম আটকে রয়েছে। বাজারে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক না থাকলে বিদেশিরা তো থাকবেন না। এছাড়া বর্তমানে ডলার বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই তারা ডলারের দাম আরও বৃদ্ধির আগে তারা বিনিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি।